Beyond Lies The Wub By Phillip K. Dick
অনুবাদঃ রাকেশ কুমার দাস
অপ্টাস বলে লোকটি তখনও দাঁড়িয়ে ছিল বিষন্ন মুখ করে। মালপত্র প্রায় সবই তোলা হয়ে গেছে। তাকে মহাকাশযানের কাছে বুকের কাছে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ক্যাপ্টেন ফ্র্যাংকো নিজেই তরতর করে নেমে এলেন ঢালু জেটিতে দ্রুত পা ফেলে।
‘কি ব্যাপার মশাই, আপনার মুখ গোমড়া কেন?’, হাসি হাসি মুখ করে ফ্র্যাংকো বললেন, ‘আরে বাবা এর জন্য পুরো টাকা তো আপনি পাচ্ছেন? না কি? ‘
অপ্টাস তবু কিছু বলল না। জোব্বার মতো পোশাকটাকে সামলে মুখ ঘুড়িয়ে নিয়ে চলতে উদ্যত হল। ফ্র্যাংকো তার বুট দিয়ে জোব্বার ধারটাকে রাস্তার সাথে চেপে অপ্টাসকে আটকাতে গেলেন।
‘আরে দাঁড়ান দাঁড়ান, দু-মিনিট দাঁড়িয়ে যান। আমাদের কথা তো এখনও শেষ হল না’।
‘ওহ তাই’, বলে অপটাস বুক চিতিয়ে বলে উঠলো,’আমি গ্রামে ফিরে যাচ্ছি।’ তার পর কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে পশুপাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল যেগুলোকে মহাকাশযানে তোলা হচ্ছিল খাঁচায় করে। শেষে আবার বলে উঠল, ‘আবার শিকার ধরতে হবে নতুন করে।’
ফ্র্যাংকো সিগারেটটা ধরিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ আপনারা তো একটু কষ্ট করলেই মাঠে ঘাটে আরও এরকম শিকার পেয়ে যাবেন। কিন্তু ভাবুন একবার মঙ্গল থেকে পৃথিবীর রাস্তার মাঝপথে যদি….’
অপটাস ততক্ষণে চুপচাপ হাঁটা দিয়েছে। মহাকাশযানের দিকে ফার্স্ট মেটকে হেঁটে আসতে দেখে ফ্র্যাংকোও এগিয়ে গেল।
‘কি ব্যাপার, কেমন মাল পেলেন?’ ফ্র্যাংকো বললেন ফার্স্ট মেটকে। ‘আমরা মোটামুটি ভালই সস্তায় পেয়ে গেলাম তাই না?’
ফার্স্ট মেট রাগত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’আপনি কি বলতে চাইছেন?’
‘আরে বাবা, রেগে যাচ্ছ কেন? ওদের থেকেও আমাদের বেশী দরকার।’ ক্যাপ্টেন বলল।
‘পরে কথা হবে ক্যাপ্টেন’ বলে ফার্স্ট মেট সিঁড়ি বেয়ে উঠে মহাকাশযানের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল। সিঁড়িটা কে বিচ্ছিন্ন করে ফ্র্যাংকোও মহাকাশযানের মধ্যে ধুকে যাবে, এমন সময়ে ফ্র্যাংকোর চোখ আটকে গেল প্রানীটার ওপর।
অস্ফুটে ‘বাপরে’ বলে কোমরে হাত দিয়ে দেখতে লাগল। রোদে পুড়ে লাল মুখ করে পিটারসন রাস্তা দিয়ে প্রাণীটাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে আনছিল।
‘সরি, একটু দেরী হয়ে গেল ক্যাপটেন’ বলে দড়িটা বাঁধছিল।
‘এটা আবার কি হে? ‘ ফ্র্যাংকো পিটারসনের কাছে যেতে যেতে প্রশ্ন করল।
‘এটাকে ওয়াব বলে,’, পিটারসন বলল। ‘গ্রামের এক লোক এটাকে পঞ্চাশ সেন্টে বেচে দিল।এটা না কি অদ্ভুৎ প্রকৃতির জন্তু। এরা না কি আবার এটাকে সম্মান করে। ‘
‘এটাকে সম্মান করে? ‘ ফ্র্যাংকো জন্তুটার গর্দানের কাছটায় আঙুল দিয়ে টিপতে টিপতে বলল, ‘এটা তো শুয়োর! বিশাল বড় নোংরা শুয়োর একটা এটা।’
‘হ্যাঁ স্যার, এটা এক রকম শুয়োরই বটে। এখানে এটা কে ওয়াব বলা হয়। ‘
ওয়াবটা বেশ এতটা হেঁটে এসে গলদঘর্ম হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। দাঁড়ানোর ফলে কিছুটা বিশ্রাম পেল। ধীরে ধীরে বসে পড়ল ওয়াবটা, চোখটা আর্ধেক বন্ধ করে। কয়েকটা মাছি ভনভন করছিল, লেজ নাড়িয়ে তাদের তাড়াতে লাগল।
‘শুয়োরটা তো বিশাল হে পিটারসন, অন্তত চারশো পাউন্ড তো হবেই’। বলেই ফ্র্যাংকো একগোছা লোম খামচে ধরল। ওয়াবটা সাথে সাথে ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠল। ছোট্ট চোখটা একটু খুলল, জলে ভর্তি। বিরাট মুখটা যেন একটু কেঁপে উঠল।
টস করে এক ফোঁটা চোখের জল ওয়াবের গাল বেয়ে মাটিতে পড়ল।
পিটারসন একটু ঘাবড়ে গেল, অন্যমনস্ক ভাবে বলল, ‘খেতে ভাল হবে মনে হচ্ছে’।
‘একটু পরেই সেটা বোঝা যাবে।’ ফ্র্যাংকো বলল।
টেক-অফের সময়টা মোটামুটি সামলে নিল ওয়াব। তারপর এককোনে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর যানটা মোটামুটি নির্বিঘ্নে মহাকাশের মধ্যে চলে এলে ক্যাপ্টেনের হুকুম হ’ল ওয়াবটাকে ওপরে ক্যাপ্টেনের কাছে নিয়ে যাওয়ার। কি ধরনের জন্তু একটু বুঝতে চায় ফ্র্যাংকো।
ওপরে যাওয়ার রাস্তাটা সরু হওয়ায় ওয়াব নিজেকে কোনমতে কুঁকড়ে নিয়ে চলল ঘোঁতঘোঁত করতে করতে আর সোঁ সোঁ করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে।
‘এই তো আসুন স্যার’ বলে জোন্স বলে ছেলেটা ওয়াবের গলার দড়িটায় টান মারল। ওয়াবটার শরীর সরু প্যাসেজের মধ্যে মুচড়ে, দেওয়ালে ঘসটে এসে হুমড়ি খেয়ে এসে পড়ল হলঘরের মধ্যে। ওটাকে দেখেই যারা বসে ছিল তড়াক করে লাফিয়ে উঠল।
‘ও হরি,’ ফ্রেঞ্চ বলে উঠল, ‘এটা কি গো?’
‘পিটারসন তো বলল এর নাম ওয়াব,’ জোন্স বলল, ‘ওই যোগাড় করেছে এটা, নিয়মমতো এটা পিটারসনের সম্পত্তি।’ জোন্স এই কথা বলে একটা লাথি কষাল ওয়াবটাকে লক্ষ্য করে। ওয়াবটা ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়াতে লাগল হাঁফাতে হাঁফাতে।
ফ্রেঞ্চ ছোকড়া ওয়াবের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘ এর কি হয়েছে? হাঁফাচ্ছে কেন? অসুস্থ নয় তো?’
সবাই মিলে ওয়াবটাকে লক্ষ্য করতে লাগল। ওয়াবটাও কাঁদোকাঁদো চোখে সবাইকে দেখতে লাগল।
‘জল খাবে মনে হচ্ছে,’ বলে জল আনতে চলে গেল পিটারসন।
ফ্রেঞ্চ বলল,’এই জন্যেই মনে হচ্ছে আমাদের স্পেসশীপটা উড়তে পারছিল না। ওজনের হিসেবটা কিছুতেই মিলছিল না। ‘
ইতিমধ্যে পিটারসন জল নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। পিটারসনের থেকে চুকচুক করে জল খেতে লাগল, মনে হল বেশ কৃতজ্ঞ।
ক্যপ্টেন ফ্র্যাংকো ঘরে ঢুকেই ওয়াবটার দিকে এগিয়ে চোখ কুঁচকে পরীক্ষা করতে লাগল, ‘কই দেখি কী জিনিস বাবা তুমি? সত্যি পিটারসন, এই সরেস মালটি মাত্র পঞ্চাশ সেন্টে পেয়েছ?’
‘ইয়েস স্যার। এ সব খায়। একে দানা খাইয়েছিলাম, বেশ গপগপ করে খেল। তারপর আলু দিলাম। এর ওর পাতে যা পড়ে ছিল সেটাও দিলাম। খেতে মনে হয় ভালবাসে খুব। আর খাবার পর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।’
‘বাহ, এনার টেস্টটা বোঝা গেল। কিন্তু একে বেশি খাইয়ে আর মোটা করে কি কোন লাভ আছে? মোটা কি কিছু কম আছে? রাধুনিকে ডেকে এনে দেখাও। আমি জানতে চাই —‘
’এই খাইখাই বাদ দিয়ে অন্য ব্যাপারে কি কথা বলা যায় না?’ সারা ঘর হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল। সবাই দেখল এবং শুনলো জল খাওয়া থামিয়ে ওয়াবটি স্পষ্ট বলল ক্যাপ্টেন কে।
‘কে বলল? ‘ ফ্র্যাংকো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল।
‘এই তো এই ওয়াবটা বলল স্যার,’ পিটারসন নিজেও কম অবাক হয়নি।
‘কই কি বলল?কি বলল ওয়াবটা?’
‘অন্য ব্যাপারে কথা বলতে বলল।’
‘স্ট্রেঞ্জ,’ বলে ফ্র্যাংকো আবার পরীক্ষা করতে গেল ঘরের অন্য প্রান্তে। তারপর আবার অন্যান্যদের কাছে ফিরে এল।’মনে হচ্ছে এটার ভেতর কেউ লুকিয়ে আছে। কেটে দেখা যায় না?’
‘উফ্ ভগবান’, ওয়াবটা গলা উঁচু করে বলল,’ সারাদিন শুধু কাটাকাটি আর খাওয়াদাওয়া, এর বাইরে কিছু ভাবতেও পারা যায়না? ‘
একথা শুনেই ফ্র্যাংকোর আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। ঘুঁষি বাগিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘বেড়িয়ে আয়! ভেতর থেকে বেড়িয়ে আয়!’
কেউই বেড়িয়ে এলো না, কিচ্ছুটি নড়ল না। সবার মুখ সাদা হয়ে গেছে, একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওয়াবটার দিকে।
‘মাফ করবেন, আপনি কি আমাকে কিছু বলছেন?’ ওয়াব বলে উঠল।
জোন্স চাপা স্বরে বলল,’ভেতরে কেউ নেই বলেই মনে হচ্ছে’। সকলে এর ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিল।
এমন সময় রাধুনি হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল। বলল,’আমায় ডেকেছিলেন স্যার?’
‘হ্যাঁ, এটা হল একটা ওয়াব। এটাকে কেটে রান্না করে খেতে হয়। বুঝলে? এটাকে আগে ওজন কর আর আমাকে বল যে…’, ফ্র্যাংকোর কথা শেষ হওয়ার আগে ওয়াব বলে উঠল, ‘তার আগে একটা আলোচনা হয়ে গেলে ভাল হত না? মনে হচ্ছে আমাদের মৌলিক চাহিদা সম্পর্কীয় সমস্যা নিয়ে আপনার সাথে আমার মতের অমিল রয়েছে।’
ক্যাপ্টেন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোচ্ছিল না। ওয়াবটা জল খেতে খেতে নিপাট ভদ্রলোকের মতো অপেক্ষা করছিল ক্যাপ্টেনের জবাবের।
‘ঠিক আছে,’ অবশেষে জবাব এল ক্যাপ্টেনের থেকে,’ আলোচনা হোক, আমার অফিসে চ… মানে এসো।’ বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। ওয়াবটাও উঠে দাঁড়িয়ে হনহন করে ক্যাপ্টেনের পেছন পেছন হাঁটা দিল। সবাই অবাক হয়ে শুনল, দিব্বি সেটা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।
রাধুনি জোন্সকে বলল,’কি হবে গো এবার? যাকগে আমি রান্নাঘরে রয়েছি, কিছু জানতে পারলে খবর দিও।’
‘হুমম’ বলে সম্মতি জানালো জোন্স।
ওয়াব এককোনে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে পড়ল। ‘আমাকে মাফ করবেন, আরাম করার নানাবিধ প্রক্রিয়ার সাথে আমি অভ্যস্ত। বিশেষ করে এত বড় একটা জায়গা…’ ওয়াবকে কথা শেষ করতে না দিয়েই মাথা নাড়িয়ে তাকে থামাল ফ্র্যাংকো। হাত বুকের কাছে ভাঁজ করে চেয়ারে ধপাস করে বসে বলল,’ঠিক আছে, তাহলে আলোচনা শুরু করা যাক। তোমরা হলে যাকে বলে ওয়াব, তাই তো?’
‘আজ্ঞে তাই মনে হয়। গ্রামের লোকেরা তো এই নামেই ডাকে। যদিও আমাদের আলাদা নাম আছে’।
‘আর ইংলিশ? পৃথিবীর লোক লোকের সাথে আগে মোলাকাত হয়েছে?
‘আজ্ঞে না’।
‘তাহলে ইংলিশ বলছ কি করে?’
‘ইংলিশ? আমি কি ইংলিশ বলছি? আমি সচেতন ভাবে কোন নির্দিষ্ট ভাষা বলছি না। আমি আপনার মন টা পর্যবেক্ষণ করে… ‘
‘কি? আমার মন?’
‘হ্যাঁ, মন অর্থাৎ আপনার স্মৃতির যে অংশে বিভিন্ন শব্দের অর্থ সূচী বদ্ধ করে রাখা আছে সেটাই শিখে নিয়েছি বলতে পারেন।’
‘ও বুঝেছি! টেলিপ্যাথি। কি তাইতো? ‘
একটু থেমে ওয়াব আবার বলতে শুরু করল,’ আমরা অনেক পুরোনো যুগের প্রজাতি। এত বড় দেহ নিয়ে আমাদের নড়তে চড়তেই অনেক কষ্ট হয়। আপনাদের মত ছোটখাটো আর ক্ষীপ্র জীবের সাথে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতাও আমাদের নেই। গায়ের জোরে নিজেদের সুরক্ষা দেব কি করে? দৌড়ে পালাতে পারব না, এত নরম দেহ কাউকে মারলেও তার লাগবে না, সবচেয়ে বড় কথা শিকার ধরার জন্য ছোটাছুটি করাটাও আমাদের ভদ্রতায় বাধে।’
‘তাহলে বেঁচে আছেন কি করে? ‘
‘গাছ, শাকসবজি এইসব খেয়ে। আমরা মোটামুটি সর্বভুক। আমরা আসলে সনাতনী ধর্মের। পরমসহিষ্ণু, উদারচিত্তের সনাতনী। এভাবেই আমরা চিরকাল বেঁচে এসেছি।’
ওয়াব এবার ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে বলল,’আর এই কারনেই আমাকে সেদ্ধ করে খাওয়ার অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে আপত্তি জানিয়েছি। আমি দিব্য দেখতে পাচ্ছিলাম আমাকে খাওয়ার ছবিটা আপনার চিন্তায় কিভাবে তৈরী হচ্ছিল – আমার দেহের বেশীর ভাগ মাংসই হিমায়িত খাদ্যের বাক্সে ঢোকান হল, কিছুটা কেটলিতে সুপের মধ্যে ভাসছিল। ছবি অনুসারে আপনার পোষা বিড়ালটারও আমার মাংসের কিছু অংশ পাওয়ার কথা – ‘
‘বেড়ে ক্ষমতা তো! এরকম ভাবে মনের ভিতরের ছবি দেখে নিতে পারেন?’ ক্যাপ্টেন বেশ উৎসাহ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল,’এরকম আর কি সুপার পাওয়ার আছে আপনার?’
‘এই কিছু টুকিটাকি ক্ষমতা আছে আর কি…’ বলতে বলতে ওয়াব আনমনা হয়ে গেল। ঘরের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বলতে লাগল,’ আপনার ঘরটি বেশ পরিপাটি করে গোছান। পরিচ্ছন্ন প্রাণীদের আমি সম্মান করে থাকি। মঙ্গলগ্রহের কিছু পাখিও বেশ পরিচ্ছন্ন। নিজেদের বাসা থেকে অকাজের জিনিস ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দেয় -‘
‘তা দেয় হয়ত।’ ক্যাপ্টেন বলে উঠল, ‘ কিন্তু আমাদের মূল সমস্যায় ফিরে আসলে ভাল হয়।’
‘হ্যাঁ নিশ্চয়। আমাকে রান্না করে খাবার কথা হচ্ছিল। স্বাদের ব্যাপারে যদি জিজ্ঞেস করেন, আমি বলব আমাদের মাংস বেশ সুস্বাদু। একটু চর্বি বেশি পাবেন, কিন্তু একদম নরম। কিন্তু আমাকে যদি আপনারা খেয়ে নেন তাহলে আপনাদের সাথে আমার স্থায়ী ভাববিনিময়ের সম্পর্ক কিভাবে স্থাপিত হবে? সত্যি, একজনকে খেয়ে নেওয়ার মত এত জঘন্য ও বর্বর চিন্তা মাথায় আসল কী করে আপনার! শিল্পকলা, দর্শন ইত্যাদি নিয়ে আলোচনার কথা মাথায় এলো না?’
ক্যাপ্টেন দাঁড়িয়ে পড়ল। ‘দর্শন? আমার দর্শন, এটাকে ভবিষ্যৎ দর্শন বলা যায়, আমাকে বলছে পরের মাসে আমাদের না খেয়ে মরতে হচ্ছে। পচন লেগে আমাদের সংগ্রহের সব খাবার নষ্ট…’
‘আমি জানি’ ওয়াব মাথা নেড়ে বলল,’ তবে সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র আমাকে বলির পাঁঠা না করে কোন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একজন কাউকে বেছে নেওয়া যেতে পারত। গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্যই হল এই জাতীয় স্বাধীকার লঙ্ঘনের পরিস্থিতি থেকে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষিত রাখা। আচ্ছা যদি এমন করা যায় যে সবাইকে একটা করে ভোট দিতে বলা হল…’
‘গণতন্ত্রের নিকুচি করেছে’ বলে ফুঁসতে ফুঁসতে ঘরের দরজাটা খুলে দাঁড়িয়ে রইল ক্যাপ্টেন, নড়তে পারছে না।
ওয়াব দেখল ক্যাপ্টেন থম মেরে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার দিকে তাকিয়ে, হাতটা দরজার হাতলে। ওয়াব ধীরে ধীরে পাশ কাটিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। সোজা নিচে নেমে এল সে, তারপর ধ্যানের মধ্যে ডুবে গেল।
ক্যাপ্টেন ওই ভাবেই দাঁড়িয়ে রইল, চোখটা ঠিকড়ে পড়ছিল, চোয়ালটা ঝুলেছিল।
ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে ওয়াব বলে উঠল, ‘তাহলে দেখা যাচ্ছে আমাদের দুই জাতির পুরাণেও বেশ খানিকটা মিল আছে। তোমার মনের ভেতর যেসব পুরাণের গল্প আর প্রতীক দেখা যাচ্ছে তার অনেকটাই আমাদের মতো। দেবী ইশতার, ওডিসিয়াস… ‘
পিটারসন একটু দূরে মাথা নিচু করে চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল। ওয়াব থামাতে বলে উঠল, ‘আপনি বলে যান।’। পিটারসন কাছের একটা চেয়ারে চলে এল আরও ভাল করে শোনার জন্য।
‘হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম। যে কোন আত্মসচেতন জাতির
পূরাণেই ওডিসিয়াস এর মতো একজন চরিত্র দেখা যায়। ওডিসিয়াস বল, বা ইউলিসিস, আমার ধারণা তিনি নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত একজন ব্যক্তি। দুর্গমস্থানে যাত্রা তাঁর পরিবার ও দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার বিরহচেতনাকেই গড়ে তোলে। এটাই অনন্য ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার প্রক্রিয়া। ‘
‘কিন্তু ওডিসিয়াস বাড়ি ফিরেছিল,’ পিটারসন জানলা দিয়ে অসীম নক্ষত্ররাজির দিকে তাকিয়ে বলল,’ শেষ পর্যন্ত সে বাড়ি ফিরে এসেছিল…’
‘সেটাই তো উচিত, ফিরে আসাটাই তোমার কর্তব্য, তাই নয় কি? বিচ্ছেদের পর্যায়টুকু সাময়িক, বলতে পারো তোমার আত্মার ছোটখাটো একটা যাত্রা। যা শুরু যেমন হয়, তেমনি শেষও হয়। অভিযাত্রী যাত্রা শেষে ফিরে আসে তার দেশে, কাছের মানুষের কাছে…’
ওয়াব থেমে গেল হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে। বিশাল মাথাটা ঘুরিয়ে দেখল ক্যাপ্টেন ফ্র্যাঙ্কো এসেছে। তার পিছনে কিছু আরও লোক এসেছে, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ইতঃস্তত করছে ঢুকবে কি না।
ফ্রেঞ্চ বলল,’তুমি ঠিক আছো? ‘
‘আমি? ‘, পিটারসন বলল, ‘কেন আমার কি হয়েছে?’
ফ্র্যাঙ্ক বন্দুকটা নামিয়ে বলল, ‘এখানে আসো আগে। চেয়ার থেকে ওঠো।’
সবাই চুপ।
ওয়াব পিটারসনকে বলল,’যাও যাও। কোন ব্যাপার না।’
পিটারসন দাঁড়িয়ে উঠল, ‘কি কারনটা কি? ‘
‘হুকুম আছে’।
পিটারসন অগত্যা দরজার দিকে হাঁটা দিল। ফ্র্যাঙ্কো পিটারসনের হাতটা জাপটে ধরে নিল।
‘আরে কি হচ্ছে এসব? ‘ গলা চড়িয়ে বলল পিটারসন।
ফ্র্যাঙ্কো এবার ওয়াবের কাছে এল। ওয়াব যেমন দেওয়ালে ঠেস দিয়ে মেঝেতে বসে ছিল এককোনায়, সেখান থেকে মাথা তুল তাকাল।
‘অদ্ভুত ব্যাপার, তুমি এখনো ভেবে চলেছ কি করে আমাকে খাওয়া যায়, ‘ ওয়াব বলল,’ কেন বুঝতে পারছি না।’
‘উঠে দাঁড়া’, ফ্র্যাঙ্কো বলল।
‘যো হুকুম।’ ওয়াব ঘোঁতঘোঁত করে উঠতে লাগল, ‘তবে আমার পক্ষে এই বপু নিয়ে ওঠা বসা করা একটু কষ্টদায়ক, একটু ধৈর্য ধরতে হবে। ‘ বলেই হাঁফাতে লাগল। জিভটা ঝুলতে লাগল।
‘এবার গুলি কর,’ ফ্রেঞ্চ হুকুম করল।
‘নাআআ! ‘ পিটারসন উত্তেজনায় ফেটে পড়ল। জোন্স পিটারসনের দিকে তাকাল। জোন্সের চোখে ভয়ের ধূসর আভা দেখা যাচ্ছে।
‘তুই দেখিস নি… একটা স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে ছিল। মুখ খোলা, বন্ধও করতে পারে নি। আমরা না এলে এখনও ওরকমই থাকত।’
‘কে? ক্যাপ্টেন? ‘ পিটারসন চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘এখন তো ঠিক আছে…’
সবাই ওয়াবের দিকে তাকালো, ঘরের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে, বিশাল বক্ষটা নিঃশ্বাসের সাথে উঠছে পড়ছে।
‘সরে যা, দরজার থেকে সবাই সরে যা’, ফ্র্যাঙ্ক বলল।
বাকীরা বিনা বাক্যব্যয়ে সরে দাঁড়াল ওয়াবের দিকে তাকিয়ে।
‘তুমি বেশ ভয় পেয়েছ, তাই না?’ ওয়াব বলে চলল, ‘কিন্তু তোমাকে তো আমি কিছু করিনি। কাউকে আঘাত করার ঘোরতর বিরোধী আমি। আমি যেটুকু করেছি শুধুমাত্র নিজেকে বাঁচানোর জন্য। তুমি কি দেখতে চেয়েছিলে? আমি নিজেই আমার মৃত্যুর দিকে উৎসাহিত হয়ে ঝাঁপ দেব? আমি তোমাদের মতোই চিন্তাশীল প্রজাতি। আমি চেয়েছিলাম তোমাদের সম্পর্কে জানতে, তোমাদের এই মহাকাশযানের খুঁটিনাটি বুঝতে। এমন কি আমি তো এও প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে গনতন্ত্র রক্ষার খাতিরে…’
ফ্র্যাঙ্কো বন্দুকটা শব্দ করে তুলল, ‘দেখেছ? যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই।’
ওয়াব কেমন থতমত হয়ে থেমে গেল। হাঁফাতে হাঁফাতে বসে পড়ল পা বের করে আর লেজটা দিয়ে গোল করে ঘিরে।
‘এইখানটায় একটু বেশী গরম’, ওয়াব কিছুক্ষণ পর আবার বলল, ‘ বোধ হয় কাছাকাছি আছে জেট। পারমাণবিক শক্তি। প্রযুক্তির দিক থেকে বলতে গেলে তোমরা অনেক দারুন দারুন জিনিস তৈরি করেছ। কিন্তু তোমাদের বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার যে শ্রেণিবিভাগ তাতে কোথাও নৈতিকতা থেকে উঠে আসা প্রশ্নের সমাধান…’
ফ্র্যাংকো ঘুরে পিছনের লোকেদের দিকে তাকাল, তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে।
‘আমি মারবো ওটাকে, আপনি দেখুন শুধু।’
ফ্রেঞ্চ মাথা নারল, ‘একদম ঘিলুটাকে তাক করবি। এই জিনিস আর গলা দিয়ে নামবে না মনে হয়। বুকে মারবি না একদম, পাঁজরার হাড় ভেঙে গেলে আবার আরেক ঝামেলা। ভাঙা হাড় বের করতে হবে। ‘
‘শোন শোন’ পিটারসন বলল ঠোটটাকে একটু চেটে নিয়ে,’ এ কি কিছু করেছে এখনও? কি ক্ষতিটা করেছে তোমাদের? আর হাজার হোক, একে আমি পেয়েছি এটা আমার। একে মেরে ফেলা কোন অধিকার তোমাদের নেই। তোমাদের বাপের সম্পত্তি না। ‘
ফ্র্যাঙ্কো বন্দুক তাক করতে লাগল।
‘আমি এসব দেখতে পারব না, আমি বাইরে যাচ্ছি।’ জোন্স বলল। তার মুখ সাদা হয়ে গেছিল।
‘আমিও চললাম’, এবার ফ্রেঞ্চ বলে উঠল। ওদের দলটা কেমন যেন ভেঙে গেল, সবাই চাপা স্বরে কিছু বলাবলি করতে করতে দরজা দিয়ে বেরোতে লাগল। পিটারসন শেষ অবধি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। বেশ মুষড়ে পড়ে বলল, ‘ ও কিই বা করত? আমার সাথে পূরাণের গল্প করছিল।’
পিটারসনও বাইরে বেড়িয়ে গেল।
এবার ফ্র্যাঙ্কো ওয়াবের দিকে হেঁটে এগিয়ে গেল। ওয়াব ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকাল। ঢোঁক গিলে বলল, ‘ খুবই নির্বোধের মত কাজ করছ। এই ঘৃণ্য কাজ তুমি যে স্বেচ্ছায় হাতে তুলে নিয়েছ তাতে আমি অত্যন্ত মর্মাহত। তোমাদের ধর্মগ্রন্থেই তোমাদের ত্রাতাপুরুষকে নিয়ে একটি নীতিগল্প আছে না যেখানে… ‘
মুখের সামনে বন্দুক দেখে ওয়াব থেমে গেল। বন্দুকের দিকেই তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ পারবে কি আমার চোখে চোখ রেখে গুলি চালাতে? পারবে? ‘
‘ চোখে চোখ রেখেই গুলি করব। খামারে নোংরা নোংরা কাঁটাওয়ালা শুয়োর মেরেছি অনেক। তোকে মারতে আমার কোন অসুবিধা হবে না। ‘
ওয়াবের ভেজা চোখদুটো চিকচিক করছিল। সেইদিকে তাকিয়ে থেকেই ক্যাপ্টেন ফ্র্যাঙ্ক ট্রিগারটা চেপে দিল।
স্বাদে অতুলনীয় ছিল।
সবাই বিরসবদনে খাবারটেবিলে বসে ছিল। কেউ কেউ মুখে কিছুই তুলছিল না। একমাত্র একজনই যে উল্লসিত ছিল সে হল ক্যাপ্টেন ফ্র্যাঙ্ক নিজে।
‘আরেকটু হোক তাহলে? ‘ চারপাশে বসে থাকা লোকদের দিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেন বলল,’আরেকটু নাও তোমরা? সাথে মদও নাও লাগলে। ‘
‘আমি আর নেব না’, ফ্রেঞ্চ বলল, ‘ আমি যাই, চার্টরুমে কাজ আছে। ‘
‘আমিও উঠছি’, চেয়ার ঠেলে জোন্স দাঁড়িয়ে পড়ল। ‘পরে দেখা হচ্ছে।’
আরও অনেকেই বিদায় জানাল। ক্যাপ্টেন তাদের চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে ছিল।
‘কি ব্যাপার পিটারসন? তোমার কি মনে হয়?’ ক্যাপ্টেন পিটারসনের দিকে ঘুরে বলল। পিটারসন প্লেটের দিকে তাকিয়ে বসেছিল। আলুটাকে দেখছিল, সবুজ মটরশুঁটিগুলোকে দেখছিল। আর দেখছিল নরম তুলতুলে গরম মাংসেটার দিকে।
পিটারসন মুখ খুলল কিন্তু কিন্তু কোন কথা বলত পারল না।
ক্যাপ্টেন পিটারসনের কাঁধে হাত রেখে বলল,’ এখন এটা শুধুমাত্র জৈবপদার্থ, জীবনের অস্তিত্ব এখন আর নেই এটায়।’ পাঁউরুটির টুকরোটায় চামচে করে একটু ঝোল লাগাতে লাগাতে বলল, ‘ আমি নিজে খেতে খুবই ভালবাসি। যেকোন চেতনাশীল জীবের উপভোগ্য শ্রেষ্ঠ কার্যগুলির অন্যতম হল এটা। খাদ্যগ্রহন করা, বিশ্রাম নেওয়া, ধ্যান করা, আলোচনা করা ইত্যাদি।
পিটারসন মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। জনাদুয়েক লোক আরো বেড়িয়ে গেল। ক্যাপ্টেন ঢকঢক করে আরও জল খেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
‘যা বলছিলাম,’ ক্যাপ্টেন বলল, ‘ দারুন খাওয়াদাওয়া হল, এ নিয়ে কোন সন্দেহই নেই। যা শুনেছিলাম এযাবৎ এই ওয়াবের মাংসের স্বাদ নিয়ে, সবই সত্যি দেখছি। সত্যিই দারুন খেতে। কিন্তু আগে কোনদিন খেতে পারিনি ইচ্ছে থাকলেও। বারন ছিল। ‘
ন্যাপকিন দিয়ে ঠোটটা মুছতে মুছতে ক্যাপ্টেন চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। পিটারসন তখনও বিষন্ন মখে খাবারটেবিলে তাকিয়ে ছিল।
ক্যাপ্টেন সামনের দিকে ঝুঁকে পিটারসনকে নিরীক্ষা করে দেখল একবার। বলল ,’আরে এসো এসো। একটু আনন্দ করা যাক। আলোচনা হোক একটু।’
বলে ক্যাপ্টেন একটু হাসল।
‘যা বলছিলাম আর কি, মাঝে নানা ঝামেলায় কথাটা শেষ করতে পারিনি, আমাদের পূরাণে ওডিসিয়াসের ভূমিকা হল অনেকটা.. ‘
পিটারসন সশব্দে দাঁড়িয়ে পড়ল, একদৃষ্টে উৎসুকভাবে ক্যাপ্টেন ফ্র্যাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে রইল চোখ বড় বড় করে।
‘যে বলে চলে চলেছে চরৈবেতি চরৈবেতি, অর্থাৎ তুমি চলিতে থাক, চলিতে থাক। আমি যেটুকু ধারনা পেয়েছি তাতে মনে হয় ওডিসিয়াস… ‘
[ মূল গল্প – Beyond Lies The Wub By Phillip K. Dick ]
First Draft